☆ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম
☆ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
☆ ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম
☆ জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
-
এক নজরে সঙ্কেতন:
- উপস্থাপনা
- স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বকথা
- স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা
- ১৯৭০ - এর জাতীয় নির্বাচন
- ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি
- অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা
- রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ
- আলোচনার প্রহসন
- স্বাধীনতা ঘোষণা
- অস্থায়ী সরকার গঠন
- মুক্তিবাহিনী গঠন ও চূড়ান্ত বিজয়
- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রাপ্তি
- উপসংহার
উপস্থাপনা :
দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ও লাখো জনতার জীবনদানের এক রক্তিম ইতিহাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম । ইংরেজ শাসন অবসানের মধ্য দিয়ে স্বপ্নের পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও পাকিস্তানি শাসকগণ পরিণত হয় শোষকে । তাদের বৈষম্যমূলক আচরণ আর শোষণ - নিষ্পেষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আন্দোলনে গর্জে ওঠে বাংলার জনগণ । কালে তা রূপ নেয় স্বাধীনতা সংগ্রামে । অবশেষে নয় মাস সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের পর উদিত হয় স্বাধীন বাংলার নবীন সূর্য ।
স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বকথা:
স্মরণাতীতকাল থেকেই বাংলাদেশ ছিল পরাধীন এবং বাঙালিরা ছিল শোষণ - বঞ্চনার শিকার । প্রায় দু'শ বছরের ইংরেজ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালে জন্ম নেয় স্বাধীন পাকিস্তান , কিন্তু পাকিস্তানি শাসকদের একরোখা শাসননীতির ফলে আমরা ছিলাম শোষিত । আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে তারা স্বীকৃতি দেয়নি । ফলে ১৯৫২ সালে ' রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ' আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে । বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপিত হয় । ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে কারাগারে আটক করলে জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা:
গণআন্দোলনের মুখে জেনারেল আয়ুব খানের পদত্যাগের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সালে পুনরায় সামরিক শাসন জারি করেন । তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেই ঘোষণা করলেন , শীঘ্রই সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সামরিক বাহিনী ব্যারাক।
১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচন:
ইয়াহিয়া খানের ঘোষণানুযায়ী ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টিতে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩৯০ টি আসনের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ( পি.পি.পি ) ৮৮ টি আসনে আর আওয়ামী লীগ ২৯৮ টি আসনে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ।
ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি:
নির্বাচনের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে ইয়াহিয়া খান গড়িমসি শুরু করেন ।
অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা:
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর পরামর্শে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করেন । ইত্যবসরে জুলফিকার আলী ভুট্টো এসে শেখ মুজিবের সাথে আলাপ - আলোচনা করে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান । কিন্তু ইয়াহিয়া খান হঠাৎ ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন । XEBER অসহযোগ আন্দোলন : ১ মার্চের ইয়াহিয়া খানের ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানের জনতা হতবাক হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ।
রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ:
অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনার জন্য ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন * সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে । * অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে । * সামরিক বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে হবে । * জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের পূর্বেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে । এ আহ্বানে সকল অফিস আদালত , কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় এবং স্বাধীনতা আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে ।
আলোচনার প্রহসন:
১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে ১৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বৈঠকে বসেন । তিনি ভুট্টো সাহেবকেও ঢাকায় ডেকে পাঠান । দীর্ঘ দশ দিন পর্যন্ত আলোচনা চলে । এ আলোচনা ছিল প্রহসন মাত্র । তীব্র আন্দোলন শুরু ও গণপ্রতিরোধ : আলোচনার নামে এহেন প্রহসনের বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন শুরু হলে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান এ আন্দোলন চিরতরে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে ২৫ মার্চ গভীর রাতে জনগণের ওপর সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমান । শেখ মুজিবকে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় । ঘুমন্ত জনগণের ওপর সেনাবাহিনীর অতর্কিত হামলায় ঢাকা শহর ভয়াল মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় ।
স্বাধীনতা ঘোষণা: ১৯৭১ সালে ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার
আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রেরণ করেন ইপিআর ঘাঁটিতে। ইংরেজিতে লেখা সেই ঘোষণাটি স্বল্প সময়ের জন্য প্রচারিত হয় ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারে। ঘোষণাটির বঙ্গানুবাদ অনেকটা এমন : ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহবান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।’
পরে ২৭ শে মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ববঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন । এ ঘোষণার সাথে সাথেই সর্বত্র সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয় ।
অস্থায়ী সরকার গঠন:
১০ এপ্রিল পূর্ব বাংলার নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যরা মুজিবনগরে এবং ১৭ এপ্রিল বহুসংখ্যক দেশি - বিদেশি সাংবাদিক , গণপরিষদ সদস্য ও মুক্তিকামী এক অধিবেশনে মিলিত হয়ে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র ঘোষণা দেয় । শপথ গ্রহণ করে এবং মেহেরপুরকেই মুজিবনগর নাম দিয়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী জনতার উপস্থিতিতে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে আম বাগানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করা হয় ।
মুক্তিবাহিনী গঠন ও চূড়ান্ত বিজয়:
অস্থায়ী সরকার গঠনের পর মুক্তিবাহিনী গঠিত হয় এবং কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে যুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গঠন ও বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয় । এ দেশের অগণিত ছাত্র - জনতা , পুলিশ , ই.পি.আর , আনসার ও সামরিক বেসামরিক লোকদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয় । তারা পাক - বাহিনীর মুখোমুখি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে । মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে পাকবাহিনীর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ে । আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নিঃশর্তভাবে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রাপ্তি:
পাকিস্তানি শোষকদের শোষণ - বঞ্চনা ও ভেদ - বৈষম্যের অবসান , অর্থনৈতিক মুক্তি , সর্বোপরি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা । কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো স্বাধীনতার চার দশক পরও মুক্তিযুদ্ধের এ চেতনা প্রতিষ্ঠিত হয়নি । পাকিস্তানের গোলামি হতে মুক্তি পেলেও বর্তমানে এ দেশ প্রতিবেশী আধিপত্যবাদী ভারতের আগ্রাসনের নিগড়ে আবদ্ধ । স্বাধীনতার পরপরই ভারত বাংলাদেশের কল - কারখানা লুট করে নিয়ে এর শিল্প ধ্বংস করে বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে পরিণত করে । ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে সুজল - সুফলা এ দেশকে মরুভূমিতে পরিণত করে । এছাড়া সাংস্কৃতিক আগ্রাসনসহ স্বাধীনতার পূর্বে যা করার সুযোগ পায়নি তার সবই এখন করতে ব্যস্ত রয়েছে তারা । বর্তমানেও সীমান্তে মানুষ হত্যাসহ করিডোর ব্যবহার , ট্রানজিট সুবিধা ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে । এখনো এ দেশের মানুষ ঘুমায় পথের ধারে , এখনো মানুষ মরে অনাহারে , এখনো জাতীয় পতাকা পোড়ানো হয় , মসজিদের ইমামকে গুম হত্যা করা হয় , মন্দিরের জমি - জায়গা দখল করা হয় । এখনো মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় , গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হয় । সন্ত্রাস , দুর্নীতি ও দুঃশাসনের কবলে পড়ে দেশবাসী আজ বড় অসহায় । আর এসবই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি । এজন্যই কবি বলেন , কী দেখার কথা কী দেখছি , কী শোনার কথা কী শুনছি , তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাকে খুঁজছি ।
উপসংহার:
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসে এক সোনালি অধ্যায় । এ অধ্যায় বড় উজ্জ্বল , অত্যন্ত বেদনা ও আনন্দের । মুক্তিযুদ্ধ থেকেই বাঙালির সত্তায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের চেতনা জন্ম নেয় । তবে স্বাধীনতার চার দশক পরেও সার্বভৌমত্ব রক্ষা , অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাংস্কৃতিক আযাদির জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে । ক্ষুধা - দারিদ্র্যমুক্ত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য দল - মত - জাতি - ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে নতুন করে শপথ নিতে হবে ।
Post a Comment